বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩১ অপরাহ্ন
আজাদ মজুমদার:
তামিম ইকবালকে প্রথম দেখার দিনটি এখনো চোখে ভাসে। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাস। বিকেএসপির মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলছিল বাংলাদেশ ‘এ’ দল। এটি সেই ম্যাচ যেখানে ইংল্যান্ডের স্পিনারদের তুলোধুনো করেছিলেন নাফিস ইকবাল।
তিন দিনের ম্যাচের প্রথম দিনেই ১১৮ রান করার পরে তার একটা উক্তি নিয়ে ইংলিশ মিডিয়ায় ছিল শোরগোল। এমনিতেই আর কোনো টিএনএজারের হাতে তারা বহুদিন এমন নাকাল হননি। তারপর দিনের খেলা শেষে ইংলিশ স্পিনারদের নাফিস বলে দিলেন ‘অর্ডিনারি।’
পরদিন নাফিসের এই ইনিংস আর উক্তি নিয়ে সবাই আলোচনা করছিলাম বিকেএসপির মাঠের পাশে। হঠাৎ নান্নু ভাই (মিনহাজুল আবেদীন) আমাদের থামিয়ে দিলেন। ‘নাফিসকে আর কী দেখলেন আপনারা, ছোটটাকে দেখেন’—একথা বলেই তিনি আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিলেন মাঠের এক কোণে।
১২-১৩ বছরের এক কিশোর সেইখানে ব্যাট হাতে মাটিতে ঠক, ঠক করছিলেন। তখনো আমাদের বোঝার অনেক দেরি এই কিশোরই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একেবারে বদলে দিতে একদিন অনেক বড় ভূমিকা রাখবেন।
জহির খান (Zaheer Khan)-এর সেই বিস্মিত মুখটা আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে। ডাউন দ্য উইকেট ছক্কা হাঁকার পর জহিরের স্তম্ভিত চেহারাটাই হয়ে যায় ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের প্রতীকী ছবি। বড় কোনো আসরে সেইটাই তামিমের প্রথম ম্যাচ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোন সাফল্যে নেই তামিম ইকবাল? ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের কথা তো শুরুতেই বললাম। পরের বছর আইসিএলকাণ্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন টালমাটাল, তামিমরা ছিলেন বলেই বাংলাদেশ তখন পথ হারায়নি।
বাংলাদেশ সেইদিন মুগ্ধ নয়নে দেখেছে নতুন এক তারার আবির্ভাব। এই মুগ্ধতার রেশ থেকে গেছে প্রায় দেড় যুগ। হ্যাঁ, তামিমের সাম্প্রতিক সময়টা ভালো যায়নি।
ব্যাটে রান নেই বেশ কিছুদিন। আগের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংও অনেকদিন অনুপস্থিত। ফিটনেস নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। অধিনায়কের বাড়তি দায়িত্বও কখনো কখনো চাপ হয়ে এসেছে। এর সবকিছু এক হয়ে পুরোনো তামিমকে অনেকটাই আড়ালে ঠেলে দেয়। কিন্তু অবসর ঘোষণা দেওয়ার পেছনে ফিরে যখন তার ক্যারিয়ারকে আরও একবার দেখে এলাম কেবল বিস্মিতই হলাম।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোন সাফল্যে নেই তামিম ইকবাল? ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের কথা তো শুরুতেই বললাম। পরের বছর আইসিএলকাণ্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন টালমাটাল, তামিমরা ছিলেন বলেই বাংলাদেশ তখন পথ হারায়নি।
সময়টা তখন এমন, যেকোনো ছোটখাটো সাফল্যও বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক বড় হয়ে যায়। কিন্তু তামিম কখনোই ছোট কিছুতে তৃপ্ত ছিলেন না। তাই চার্লস কভেন্ট্রি (Charles Coventry) যখন সাঈদ আনোয়ার (Saeed Anwar)-এর ১৯৪ রানের বিশ্ব রেকর্ড ছুঁয়ে বাংলাদেশকে চুপসে দেন, তামিম তাদের জাগিয়ে তোলেন ১৫৪ রানের কাব্যিক এক ইনিংস খেলে।
লর্ডসে খেলার আগে জিওফ বয়কট (Geoffrey Boycott) যখন বাংলাদেশকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেন, সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে অনার্স বোর্ডে নাম লেখান তামিম।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রায় সব বড় জয়েই রয়েছে তার বড় অবদান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ে তার সেঞ্চুরি আছে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়ে দুই ইনিংসেই আছে ফিফটি। নিজেদের শততম ম্যাচে যেবার শ্রীলঙ্কাকে প্রথম হারায় বাংলাদেশ সেইখানেও দ্বিতীয় ইনিংসে আছে তার ম্যাচ জেতানো ফিফটি।
পাকিস্তানকে টেস্টে বাংলাদেশে এখনো হারায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু তার প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিতেই পাকিস্তানের বিপক্ষে একবার মাত্র হার এড়ায় বাংলাদেশ। চাইলে এরকম আরও অনেক সাফল্যের কথা বলা যায়।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রায় সব বড় জয়েই রয়েছে তার বড় অবদান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ে তার সেঞ্চুরি আছে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়ে দুই ইনিংসেই আছে ফিফটি…
বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামিম এক বর্ণিল চরিত্র। অন্য অনেকের মতো বড় কোনো বিতর্ক নেই তাকে ঘিরে। অভিষেকের পর ইনজুরি ছাড়া আর কোনো ম্যাচে একবারের জন্যও বাদ পড়েনি। পঞ্চপাণ্ডবদের আর কারও এই সৌভাগ্য হয়নি। ব্যাটিং নয়, তার উদযাপনও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রায় অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।
লর্ডসে সেঞ্চুররি পর শূন্যে লাফিয়ে, যেভাবে পিঠে হাত রাখলেন তার ব্যাখ্যা জানতে লংরুমের দরজায় সেইদিন চা বিরতিতে বিশেষ সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। তার সেই অভূতপূর্ব উদযাপন, কিংবা এশিয়া কাপে টানা চার ফিফটির পর তার চার আঙুল দেখানো, এই দেশের ক্রিকেটের গল্প গাঁথায় চিরকাল রয়ে যাবে।
কথিত আছে, সেইবার চার আঙুল তামিম সেই সময়কার বিসিবি সভাপতিকেই দেখিয়েছিলেন। চেষ্টা করলে নানা সমালোচনার জবাব এইবারও এই রকম কোনো একটা উদযাপনের মধ্য দিয়েই দিতে পারতেন তামিম। কিন্তু সেই রকম কোনো চেষ্টাই করেননি। উল্টো অবসর ঘোষণা করে বসেছেন।
অবশ্য এমন এক সিদ্ধান্তের দায়ভার একা তামিমের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাকে ঘিরে যে সমালোচনা তার সবকিছু ন্যায্য ছিল না। হ্যাঁ, তার স্ট্রাইক এখন অনেক কমে এসেছিল। আগের মতো ধারাবাহিকভাবে বড় ইনিংসও খেলতে পারছিলেন না। কিন্তু এইসব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিসিবির যখন উচিত ছিল তাকে সাহায্য করা, উল্টো সবাই তাকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন।
যে সমালোচনা করা প্রয়োজন ছিল টিম মিটিংয়ে, কিংবা আলোচনায় বসে, সেই সমালোচনা হয়েছে মিডিয়ায়। তামিম এতে তার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন। তবে তার আত্মমর্যাদা বোধ বরাবরই তীব্র। এটা হারাননি বলেই সিরিজের মাঝ পথে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। আরও ভালো একটা বিদায় তামিমের অবশ্যই প্রাপ্য ছিল।
আজাদ মজুমদার ।। যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ
ভয়েস/আআ